Wednesday, October 28, 2020

কেড়কেড়া : মণিপুরিদের আকাশ প্রদীপ


কেড়কেড়া৷ মণিপুরিদের আকাশ প্রদীপ৷ কার্তিক মাস জুড়ে মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া বৈষ্ণবরা সন্ধ্যা হলে বাঁশের মাথায় বসানো লন্ঠন প্রজ্বলন করে বিষ্ণুর আশির্বাদ কামনা করে৷ উচ্চারণ করা হয় এই মন্ত্র- 'আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ।' অর্থাৎ, আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে অবস্থান করছেন যে বিষ্ণু, তাঁর উদ্দেশে দেওয়া হল এই প্রদীপ।
যারা বৈষ্ণব নন, আপোকপা ধর্মানুসারী, তারা বলেন এই প্রদীপটি লক্ষী-নারায়ণের উদ্দেশে নিবেদিত নয় বরং আপোকপা বা পূর্বপুরুষদের স্মরণে প্রজ্জ্বলন করা হয়, যারা পরলোকে আছেন তারা যেন সেই আলোর রেখা ধরে নিকটজনদের আশীর্বাদ করতে পারেন৷ কৃত্যানুষ্ঠানটির নাম 'মেরা ৱাউংবা', মেরা হচ্ছে মণিপুরি বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাস৷
যুক্তিবাদীরা বলেন, আকাশে দীপ জ্বালানো হেমন্তকাল বরনের অংশ৷ শীতের আগমনের প্রস্তুতি হিসাবে আগুন বা তাপকে সংরক্ষণ করে রাখার একটা প্রতীকি উৎযাপন যা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে৷
মণিপুরি পুরাণগুলোতে অবশ্য এই আকাশ প্রদীপের ভিন্ন গল্প আছে৷ সুদুর অতীতের কোন এক সময়ে তিনজন ভাই বসতি গড়ার জন্য পাহাড়ে উঠে ৷ ছোট ভাইটি কিছুদুর এগিয়ে আর উঠতে পারে না, সেখানেই থেকে যায়৷ বড় ভাইয়েরা পাহাড়ে উঠে বসতি গড়ে তোলে৷ যাবার আগে তারা ছোটভাইকে বলে যায়, বছরের মাঝামাঝি এই সময়টাতে সে যেন উচুঁ বাঁশের মাথায় লন্ঠন জ্বালিয়ে রাখে, যাতে ছোট ভাই ঠিক আছে কিনা তারা জানতে পারে৷ তারপর থেকে এটা মণিপুরের ঐতিহ্য হয়ে যায়৷ এই কাহিনীটি মণিপুর উপত্যকার পাহাড় ও সমতলে বাস করা ৩০টির বেশি ছোট ছোট জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্বের কথা বলে৷ মণিপুর রাজ্যে এই উৎসবটি উৎযাপিত হয় তাদের মধ্যকার বন্ধন যে দৃঢ় সেটা দেখাতে৷
যে যাই বলুক, কার্তিক মাসে আকাশ প্রদীপ দেখলে লতার এই গানটির কথাই মনে পড়ে—
'আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে,
আমার নয়ন দু’টি শুধুই তোমারে চাহে
ব্যথার বাদলে যায় ছেয়ে।।'
২৮ অক্টোবর, ২০১৭

Sunday, July 05, 2020

বাঙালি তরুণ কবির বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় কাব্যচর্চ্চা

কবি দেবাশিস চৌধুরী বাংলা ভাষার তরুণ কবি৷ থাকেন ভারতের ত্রিপূরা রাজ্যের ধর্মনগরে৷ মাতৃভাষা বাংলা হলেও তিনি কাব্যচর্চা করেন ত্রিপূরার আরেকটি প্রান্তিক ভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ঠারে৷ সেখানকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি জনগোষ্ঠীর সাথে তাঁর আত্মার সম্পর্ক৷ কবি বলেন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি তার দ্বিতীয় মাতৃভাষা ৷ প্রায় ত্রিশ চল্লিশটি কবিতা লিখেছেন এই ভাষায়৷ ভাষার দখলও অসাধারণ৷ হয়তো নিয়মিত এই ভাষার সাহিত্য পাঠ করেন৷
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় কবি দেবাশিস চৌধুরির লেখা দুইটি কবিতা তুলে ধরলাম৷
পাহুরলু⚀
মানু মরিয়া হদেইলে
পাহিয়া জিংতা অইতারা।
রাতিহান অনির আগে
চান্দগো নিকুলিয়া
মোর মুরগত পরের!
নিংশিং অনির আগেই
সভ্যতার হাবি ইতিহাস
মি পাহুরানি অকরলু!
হে ইমা মোর খৈতুগত
অমৃত না ঢালে দিস্।
ইমার পূজা⚀
কোকিলাগো রহিরি
কুহু কুহু করিরি
হেইকিরির নুংসি গতে
বসন্ত হান দেহুরি।
মেঘালা ভাবহান
হুনো মোর কথাহান
ইমার পূজা চলেছে
কাতকরৌরি হমাহান।
আহো আজি বেইবুনি
ইমার পূজা করানি
হারৌ অইয়া থানির কা
ইমার চরণে মাতানি।
বর দে দূর্গা ইমা
কতিঔ তোর মহিমা।
আমি তোর সৌ সুমারা
লদে আমার হমা।
নুয়ারা পানি দুরেই কর
ইমা খানি দয়া কর
তোর চরণে বর মাগৌরি
হাবিরে দয়া কর।
ইমা তি স্বর্গে থাইয়া
না থাইস আমারে পাহুরিয়া
মর্ত্তে তোর জিয়াজিপুত
থাইতাঙাই তোরে নিঙকরিয়া।
আমার নিজের মাতৃভাষা বিষ্ণু্প্রিয়া মণিপুরি হলেও আমি বাংলায় লেখালেখি করি৷ আরো অনেকেই করেন যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়৷ কিন্তু কোনোদিন দেখলাম না বাংলাদেশের কোনো বাঙালি কবিকে চাকমা, মারমা, ত্রিপূরা, মান্দি, মণিপুরি, সাঁওতালি কোনো ভাষায় কোনোদিন কিছু লিখতে৷ আমি খুব আশাবাদী কবি দেবাশিস চৌধুরীর মতো এমন কেউ হয়তো এই ভূখন্ড থেকেও উঠে আসবেন৷
সকল মাতৃভাষা বেঁচে থাকুক৷

Sunday, September 22, 2019

পিতৃপক্ষ



মণিপুরিদের পিতৃপক্ষের প্রসাদ ৷ পিতৃলোক হলো স্বর্গ এবং মর্ত্যের মাঝামাঝি একটা স্থান৷ মর্ত্য থেকে সরাসরি কেউ স্বর্গে যেতে পারেন না, পিতৃলোক হয়ে যেতে হয়৷ পিতৃলোকে আবার সিএনজি অটোর মতো তিন সিটের বেশি জায়গা খালি নাই৷ ওখানে অপেক্ষমান তিন জন বা পূর্বতন তিন পুরুষকে মণিপুরিরা বলেন, 'ইমুংপোকপা'৷ এই বিশ্বাসগুলো তাদের 'আপোকপা' ধর্মের অংশ যা এখন বৈষ্ণব ধর্মের সাথে প্রায় ব্লেন্ড হয়ে গেছে৷
তো এই তিন জন ইমুংপোকপা পিতৃপক্ষের এই দিনগুলোতে উত্তরপুরুষদের আতিথ্য গ্রহন করতে মর্ত্যে নেমে আসেন ৷ ফলে পিতৃপক্ষের এই ১৫টি দিন মণিপুরি মন্ডপগুলোতে পালি দেয়া হয়৷ পালি মানে শাস্ত্রপাঠ, কীর্তন ও ভোজের আসর৷ এবারের পিতৃপক্ষ ১৩-২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত৷

Tuesday, September 10, 2019

হিয়াং তানাবা


মণিপুরের ঐতিহ্যবাহী 'হিয়াং তানাবা' বা নৌকা বাইচ উৎসব৷ 'হি' মানে নৌকা, 'য়াং' অর্থ গতি৷ প্রতি বছর বর্ণাঢ্য 'লাই হারাউবা' উৎসবের শেষদিনে অনুষ্ঠিত হয় হিয়াং তানাবা৷ মণিপুরি বর্ষপঞ্জির চলতি মাসের নামও 'হিয়াংগৈ', কাজেই উৎসবটির গুরুত্ব বুঝাই যাচ্ছে৷ মিথলজি অনুসারে মণিপুরি পুরাণের দেব দেবীরা নিজেদের মধ্যে এই খেলা খেলতেন৷
হিয়াং তানাবা রেসের নিয়মকানুন ও নৌকাগুলো নিজস্ব ধাঁচের৷ প্রাচীন মণিপুর ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল, তার একটি হচ্ছে লুয়াং৷ এই লুয়াং রাজ্যের রাজা নিংথৌ পুনশিবা প্রথম নৌকার ডিজাইনটি করেন৷

Monday, October 22, 2018

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের কার্ত্তিকা উৎসব, নিয়মসেবা ও লেইরিক থিকরানি




কোজাগরী পূর্ণিমার ভরা চাঁদের রাত থেকে শুরু হবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের কার্ত্তিকা উৎসব। কার্ত্তিক মাস তাই কার্ত্তিকা। কার্ত্তিক মাসটি নানান কারণে গুরুত্বপুর্ণ। এ মাসের শেষেই মণিপুরি মহারাস। রাস উৎসবের আগে পুরো কার্ত্তিক মাস জুড়ে থাকে উৎসবের আমেজ। মুলপর্বটি "নিয়মসেবা" বা "নিয়মর পালি" নামে পরিচিত। নিয়মপালির সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ দিক হলো পুঁথিপাঠ বা পুরাণ-পাঠ। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় বলা হয় "লেইরিক থিকরানি"। শ্রোতাদের সামনে পুরাণের নির্বাচিত অংশ থেকে সুরেলা আবৃত্তি এবং মাতৃভাষায় তার সরল অনুবাদ ও ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়।
প্রাক-বৈষ্ণব আমল থেকে মণিপুরিদের মধ্যে 'য়ারি' বা গল্পের আসরের প্রচলন ছিল। যারা 'য়ারি' বা গল্প বয়ান করতেন তারা পেশাগতভাবেই এ কাজটি করতেন। কোন গল্পের কাহিনী, ভাব, রস ও চরিত্রের ব্যাখ্যা দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে শৈল্পিক বয়ানভঙ্গির মাধ্যমে উপস্থাপন করতেন তারা- আখ্যানবস্তুটি হয়তো কোন ঐতিহাসিক বা পৌরানিক ঘটনা, বা মিথলজির কোন উপাখ্যান থেকে নেয়া অথবা জীবনঘনিষ্ট কোন গল্পকে ভিত্তি করে তৈরি। এই য়ারি বা গল্পগুলো কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। জীবনঘনিষ্ঠ প্রচলিত 'য়ারি'র মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো 'আপাঙর য়ারি' বা বোকাদের গল্প। গল্পগুলো আসরের বাইরেও ঘরে ঘরে বয়োজেষ্ঠদের দ্বারাও কথিত-চর্চিত হয়ে আসছে। এই গল্পবয়ান বা কথকতা দীর্ঘকাল থেকেই শিল্পরীতি হিসাবে স্বীকৃত। মণিপুরি রাজারা নানান সময়ে এই শিল্প-আঙ্গিকের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সেই পরম্পরায় এখনো মণিপুর রাজ্যে সেরা 'লেইরিক থিবা-হাইবা'দের প্রতিবছর সম্মাননা দেয়া হয়। ষোড়শ শতকের দিকে বৈষ্ণব ধর্মের বলয়ে আসার পর সমগ্র মণিপুরে বৈষ্ণব সাহিত্য এবং হিন্দু পৌরানিক গ্রন্থ বিশেষ করে মহাভারত, রামায়ন ইত্যাদি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তখন পুথিঁপাঠের আংগিকেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
মণিপুরিদের এই পুরাণ-পাঠ বা আবৃত্তির বিশেষ একটি ঢঙ আছে, যা বাঙালিদের পুঁথিপাঠ থেকে একেবারেই ভিন্ন। পরিবেশনাটি একক বা দ্বৈত হতে পারে। একক পরিবেশনার ক্ষেত্রে যিনি পাঠ করেন তিনিই ব্যাখ্যা দেন। দ্বৈত রীতিতে দুজন পরিবেশক থাকেন- যিনি পাঠ করেন তাকে বলা হয় "থিপা", আর যিনি ব্যাখ্যাদান করেন তাকে বলা হয় "য়ারিলিপা"। থিপা আর য়ারিলিপার মিলিত পরিবেশনায় দর্শক শ্রোতাকে কখনো ভাবাবেগে অশ্রুসজল হতে দেখা যায়, আবার কখনো হাসিতে ঢলে পড়তে দেখা যায়। এভাবে শ্রোতা-দর্শকের সাথে সার্বক্ষণিক সমঝোতা ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে 'লেইরিক থিকরানি' এগিয়ে যায়। পুরাণ-পাঠকদের সবচেয়ে বড় গুণ বিষয়ের পুনর্নির্মাণ। প্রতিবার বিষয় তো সেই পুরাতন- তারই বিভিন্ন অংশ ভেঙে নিয়ে সময়োপযোগী করে দর্শকদের আনন্দ দেওয়া এবং সেইসঙ্গে চলে তলে তলে লোকশিক্ষা।
পুঁথিপাঠ শেষ হলে ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র সহযোগে বৈষ্ণব পদাবলী বা আরতি গাওয়া হয়। কখনও আয়োজন করা হয় কার্ত্তিকের ঐতিহ্যবাহী মৃদঙ্গবাদনের প্রতিযোগিতা "কার্ত্তিকর ফান্না"। সবশেষে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরন করা হয়। প্রসাদের মধ্যে থাকে গুড়ের সাথে খই বা মুড়ি মিশিয়ে ঘরে তৈরী 'কাবক' বা 'লারৌ', বিভিন্ন ধরনের ফল, মিষ্টি, চিড়া কলার ফলার, নিরামিষ খিচুড়ি ইত্যাদি।
_____________________________
চতুর্মাত্রিক ব্লগে প্রকাশিত (অক্টোবর ২২, ২০১৩)
ছবি: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি উইকিপিডিয়া

Friday, January 12, 2018

কবি সমরজিৎ সিংহের জন্মদিন আজ


কবি সমরজিৎ সিংহের জন্মদিন আজ ৷ বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় সিদ্ধহস্ত এই কবির জন্ম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ৷ অজস্র কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন প্রচুর গদ্য — গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা সাহিত্য ৷ সম্পাদক হিসাবেও সমরজিৎ সিংহ খ্যাতনামা ৷ সত্তরের দশকে ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় গিয়ে প্রায় মুমূর্ষু 'কৃত্তিবাস' পত্রিকার প্রকাশনার সাথে যুক্ত হন তিনি ৷ এই সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাহচর্যে আসেন ৷ কৃত্তিবাস পত্রিকায় ছায়াতে বাংলা ভাষার অনেক বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক বেড়ে উঠেছেন ৷ এছাড়া ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পত্রিকা 'ত্রিপুরা চে' , যেটি প্রকাশিত হত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায়, তার সম্পাদক হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন ৷ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার লেখক সম্প্রদায় সৃষ্টিতে 'ত্রিপুরা চে'র ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ৷ 'এবাকা' নামে আরেকটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন মাতৃভাষায় ৷ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কবিতার সমকালীনতায় সমরজিৎ সিংহ একজন পথিকৃৎ ৷ মাতৃভাষায় কবিতা লিখেছেন অনেক কম, কিন্তু মননশীলতার সমরজিৎ সিংহের ধারেকাছে কেউ নেই ৷
মুক্তপ্রাণ, প্রাণোচ্ছল আর তারুণ্যে ভরপুর মানুষটিকে জন্মদিনের অজস্র শুভেচ্ছা ৷
সমরজিৎ সিংহ
খন্ডগ্রাস
পরপারের আলো এসে পড়েছিল তার চিঠির অক্ষরে ।
ঐ আলো, যাকে ধ্বনিসম্ভব বলে জানি,বৌদ্ধগুহা হয়ে ঘুরপথে
এসে পড়েছে মৃত্যুর হাত ধরে ।চিঠির প্রতিটি অক্ষর
ক্রমে হয়ে উঠেছিলো ,হয়তো, রাঢ়সংস্কৃতমিশ্রিত ।
যে শব্দটি এর ভেতর ,একা,ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলতে তৎপর,
কাতর ও উন্মুখ ,তা আসলে এক ম্লেচ্ছপ্রতিম ধ্বংসবীজ ।
সমরজিৎ সিংহ
সেয়াগ
টেইপাঙহান বুলিয়া চেইঙ মি
ঔহানল গরেৎত নিকুলেসু
গরেৎত নিকুলেসু বুলিয়া
হারৌহারে আট্টিঙ্গাহান ঙালসে
রইদহান ফিরালহার সাদে পাতালা অয়া পরেসে
পাহিয়া পলেই, জুনাক জিনজুনি হাবি
বুলে বুলে চাউরি টেইপাঙএহান
এতাহাবি হারৌর বিতরে তোর মেইথঙহান
ইমাম মামসে
বৌবরনর সাদে, আদারহানর সাদে
গরেৎত নিকুলিয়া মি কিসাদে গরআগৎ হমাসুহান
হারনাপাসু, সে সেয়াগ, ঈশ্বর
এপেইয়ৌ, তোর দুঃখ য়ারি হারৌতে কুরাং?

Sunday, October 08, 2017

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি লিপি


অভ্র কি-বোর্ডে ''ৱ' নামে একটা বর্ণ দেখে থাকবেন যেটা আমরা বাংলা লেখার সময় ব্যবহার করি না ৷ বর্ণটি অসমীয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ও মৈতৈ ভাষায় ব্যবহৃত হয় ৷ বর্ণটির উচ্চারণ হয় 'উয়' (wo) ৷ আকার যোগ হলে হবে 'উয়া' (wa)৷
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি'তে ৱ বর্ণের কিছু ব্যবহারঃ
নুৱা (nuwa)
ৱাইসাঙনি ( waisangoni)
ৱারৌ (warou)
গুৱাহাটি (guwahati)
ৱানথা (wantha)
ৱাশাক (washak)
অনেকে দাবি করে থাকেন অসমীয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, মৈতৈ, উড়িয়া, মৈথিলী ভাষাগুলি বাংলা লিপি ব্যবহার করে লেখা হয় ৷ ব্যাপারটা আসলে তা নয় ৷ বাংলা বর্ণমালা নামে যে অক্ষরগুলোর সাথে আমরা পরিচিত সেগুলি আদতে বাঙালিদের উদ্ভাবিত নয় ৷ ব্রাহ্মী লিপি পরিবারের অন্তর্গত পূর্ব নাগরী লিপির একটি রূপকে ভারতবর্ষের এই অঞ্চলের কিছু ভাষাগোষ্ঠি গ্রহন করে নিজেদের ভাষা লেখার কাজে ৷ বাঙালিরা তার নাম দেয় 'বাংলা লিপি' ৷ অসমীয়াদের কাছে তা হয়ে যায় 'অসমীয়া লিপি' ৷ ওড়িয়ারা এই লিপিটাকেই গোলাকার ফরমেটে লিখত, তারা এর নাম দেয় 'ওড়িয়া লিপি' ৷ মণিপুরি মৈতৈদের নিজস্ব বর্ণমালা থাকলেও তারা এই লিপিকে গ্রহন করে বহুল ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে; প্রাচীন মৈতৈ মেয়েক পুনরুত্থানের আগে এই লিপিই 'মৈতৈ লিপি' হিসাবে পরিচিত ছিল ৷ ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার পাঠ্যবই কনাক-পাঠে এই বর্ণগুলোকেই বলা হয়েছে 'বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি মেয়েক' বা বর্ণমালা ৷
তবে কারা প্রথম এই লিপি ব্যবহার করেছে তা নিয়ে সন্দেহাতীতভাবে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয় ৷ 'কুটিল লিপি' বা বর্ণকে বাঁকা করে লেখার প্রবনতা চালু হয় খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে, কুটিল লিপি থেকেই নবম শতকের দিকে এই বর্ণগুলোর উদ্ভব হয়েছে বলে ভাষাবিদরা মনে করেন ৷ আদি বাংলা লিপির নিদর্শন পাওয়া যায় সেন আমলের রাজাদের কিছু দানপত্রে ও সুন্দরলিপিতে, একাদশ দ্বাদশ শতকের শিলালিপি, পোড়ামাটির ফলক ও প্রাচীন পুঁথিতে ৷ অনুরূপভাবে আদি অসমীয়া লিপির নির্দশন মেলে তখনকার রাজাদের আদেশনামা, ভূমি প্রদানপত্র, এবং তাম্রফলকে; সাঁচি নামক গাছের বাকলে এই অসমীয়া লিপিতে ধর্মীয় গ্রন্থ ও কাহিনী লেখা হতো । অসমীয়া বর্ণমালায় আরেকটি বর্ণ আছে ''ৰ', এটার উচ্চারণ 'র' এর মতো ৷ অপরপক্ষে প্রস্তরগাত্রে খোদিত প্রাচীন ওড়িয়া ভাষা ও বর্ণমালার রূপ মেলে তারও আগে, দশম শতকে ৷ ওড়িয়া পুঁথিগুলো অনেক প্রাচীন, ওগুলো তালপত্রে কাঠি দিয়ে লেখা হতো; কোণা থাকলে পাতা ছিঁড়ে যাবে এই ভয় থেকে এলো গোলাকার লিপির ধারনা ৷ কাজেই লিপির মালিকানা নিয়ে ধস্তাধস্তি করে তেমন লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ ৷
আজকের লেখাটি তরুণ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি লেখকদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত, যারা পূর্ব-নাগরী লিপির বর্ণগুলো ব্যবহার করে লেখার জন্য হীনমন্যতায় ভূগে থাকেন , এবং মনে করেন ওগুলো বাঙালিদের বা অসমীয়াদের মৌরসী সম্পত্তি ৷ এই পর্যায়ে এসে 'নিজস্ব অক্ষর' থাকার ধারনাটি একেবারেই বালখিল্য এবং অবাস্তব ৷ভাষা-সাহিত্যের বিকাশের জন্য নিজস্ব বর্ণমালা থাকতেই হবে এমন কথা নেই— ইংরেজি, হিন্দি বা উর্দু, কোন ভাষারই নিজস্ব অক্ষর নেই ৷

Saturday, September 16, 2017

কবি দিল্স লক্ষ্মীন্দ্র সিংহের জন্মদিন আজ


বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যের কীর্তিমান পুরুষ দিল্স লক্ষ্মীন্দ্র সিংহের জন্মদিন আজ ৷ কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য, গবেষনা - বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তার বিচরন ৷ আশির দশকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের কাব্যসাহিত্য ও সামাজিক আন্দোলনকে বেগবান করতে প্রতিষ্ঠিত 'দিল্স' ( দুখিনী ইমার লেইরাপা শৌ) নামের সংগঠনটির অন্যতম রূপকার তিনি ৷ প্রথম কাব্যগ্রন্হের নাম 'থরো' ৷ 'না কাদি তি লোগতাক', 'মণি বিসারেয়া বারো কতহান কবিতা', 'খঙচেল', 'হুনমানুর হপন', 'ইমালাম' ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ দিয়ে কাব্যপ্রেমিদের মন মন জয় করেছেন। কবিতার ফর্ম ও ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন 'মালতি- রাহাল', 'দিক মিলনর এলা' ইত্যাদি কাব্যে। ১ম গল্প সংকলন 'হুরু য়ারি' ৷ নাটকের মধ্যে 'কল্লিং', 'নিদান', 'এরে হে টেইপাং' উল্লেখযোগ্য ৷ 'কল্লিং' নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমা তৈরি হয়েছে ৷পত্রপত্রিকায় বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছেন ৷এছাড়া ভোলানাথ সিংহ ছদ্মনামে তিনি কাব্য সমালোচনাও লিখেন ৷ সমান দক্ষতা ইংরেজী ও অসমীয়া ভাষায়। অনুবাদ করেছেন সফোক্লিসের 'আন্তিগোনে' , এলিয়টের 'ওয়েস্টল্যান্ড' । লোকসাহিত্যের গল্প সংকলন 'Treasury of Bishnupriya Manipuri Folk Tales' তার অন্যতম কীর্তি ৷ সাহিত্যর পাশাপাশি গানেরও চর্চা করেন। গান লিখেন, গানে কন্ঠ দেন ৷ প্রকাশিত অডিও এলবাম 'বরন ডাহানির এলা', 'বর দেই বর দেই', 'আশার নৌগ', ও 'সেনারেই', 'কাঙর পালির এলা'।
বহুমাত্রিক এই লেখক আজ একষট্টি বছরে পা রাখলেন ৷ বয়সের ভারে নুয়ে না পড়লেও শরীরের অবস্থা তেমন ভাল নেই ৷ তিনি সুস্থ থাকবেন, শতবর্ষী হবেন, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করবেন এই কামনা করি ৷
দিল্স লক্ষ্মীন্দ্র সিংহের ২টি কবিতা । ১মটি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায়, ২য়টি অনুবাদ ।
মাগেসিলু সরা আহান
মাগেসিলু সরা আহান বারো
ঔহানর পানি
লক লকার কালোগর সাদে, বারো
আরাক জনম আহান-
কুমারী নিঙল আগোর সাদে
প্রবঞ্চনা নেই।
পস্তেয়া পস্তেয়া যারগা লাংলা-বুজা মিকুপ
সংখ্যালঘু মানুর সাদে গুজয়া গুজয়া
বারো, কাদের মোর বিতরকার ঠইগোয়-
জিরন নেই
আহির পানি
মৌজেলেইর মুতো যারগা হেদিগীর সাদে
সাপুড়িয়ায় জারিয়া বেলার হু ঔতার সাদে
কোন এক অর্থহীন জীবনের প্রতি
(শুভাশিস সিনহার অনুবাদ)
বলেছিলে আমাকে কানে কানে
মনে মনে
গহীনে
এক জীবনের অর্থহীন ক্রোধ আর অহমিকাকে
নারকেলের খোসার মতো খুলে ফেলে দাও
ছুঁড়ে ফেলে দাও ব্যর্থ জন্মভার
দুরে
ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেখছি এই আশ্চর্য জীবন
একটি নিগুঢ়, নরোম কবিতার গোপন আকাঙ্খায়
হাতের তালুতে কার রক্ত
হৃদয়ের,
নাকি ভগবানের?

Sunday, February 12, 2017

শুভ জন্মদিন কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ




আজ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কাব্যসাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের জন্মদিন । ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার পাকইরপাড়ে জন্ম নেওয়া এই কবি প্রথম জীবনে বাংলায় কাব্যচর্চা করলেও পরবর্তী সময়ে বিচরনক্ষেত্র কেবল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যের অলিগলি। কবিতার পাশাপাশি গল্প, নাটক, কথাসাহিত্য ও অনুবাদেও পেয়েছেন সাফল্য। ১৯৭২ সালে ৪০টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'লেহাও ফুলগরে' ( চাঁপাফুল, তোমাকে) । তারপর আর থেমে থাকেননি । বিশাল কাব্যহৃদয়, তীক্ষ্ণ ও অপরিমেয় কাব্যশক্তি নিয়ে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কাব্যসাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন। একসময় আধুনিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কাব্যসাহিত্যের পথিকৃৎ হিসাবে আবির্ভূত হন ধনঞ্জয় রাজকুমার ছদ্মনাম নিয়ে।
বিংশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে যাত্রা শুরু হওয়া বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যের কবিতা ধাঁচটি ছিল মুলত বৈষ্ণব পদাবলি ও ভাবলুতা নির্ভর। ফুল-পাখি-লতা-পাতা-হরি-কৃষ্ণ-রাধে-বৃন্দাবন ব্যতীত কবিতা কল্পনা করা যেত না । এইসময় একজন কবি এসে বললেন, 'শ্মশানর জ্বি'গ আহির পানিল কিসাদে নিবানি', শ্মশানের চিতা কিভাবে নেভাই চোখের জলে ? লোকজন অবাক, যাহ এভাবে কবিতা হয় নাকি । তারপর বললেন, 'ইশ্বরর লগে তুলনা দিয়া চেইতে মি কতি তলয়া আছু', ইশ্বরের সাথে তুলনা করতে যেয়ে দেখি আমি কতখানি ছোট হয়ে আছি। কি বলছে এই লোক, ইশ্বরও কি মানুষের মতো তুলনা দেয়ার রূপক হতে পারে ! কবিতা যে কেবল গান নয়, চিত্রকল্প হতে পারে, নিজের বা সমাজের বাস্তব নিষ্ঠুর সত্যের নগ্নরূপ হতে পারে তা করে দেখালেন ধনঞ্জয় । ধনঞ্জয় রাজকুমারকে এজন্যই বলা হয় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি । হতাশা, দুঃখ, ক্লান্তি ও যন্ত্রনার ভিতরেও কোন আনন্দের উপকরন জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে কিনা তার সন্ধান করে চললেন ধনঞ্জয় । কবিতায় সামষ্টিক ও ব্যক্তিক বেদনা মিলেমিশে অবাক করা এক রূপ নিয়ে নিল, যা খুলে দিল আধুনিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কবিতার প্রকরণ। ১৯৭৭ সালে ষোলোটি কবিতা নিয়ে বের হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, 'ডিগল আতহানল মোরে' । তিনি লিখলেন -
'ট্রেনের হুইশেল, মোটরের হর্ণ, প্লেনের শব্দ, ঘড়ির এলার্ম, তিনশ এগারো টাইপ রাইটারের খটখটখটখটখট, হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়া কাপ, রেডিওর ষ্টেশন খুঁজার শব্দ, আত্মহত্যার আগের নিঃশব্দতা, রক্তের কণায় অসহ্য চিৎকার মুক্তি মুক্তি, উত্তরন উত্তরন, হাজার হাজার বছরের কবিদের কবিতা পড়া আমার বুকে লাবডাব - লাবডাব - লাবডাব - ঈশ্বরের সাথে তুলনা করে দেখি আমি এখনো নিম্নজ। লাবডাব - লাবডাব - লাবডাব। সিস্টার দয়া করে আমার মুখে থার্মোমিটার দিন, আমার বুকে একবার কান পেতে শুনুন, হাতের নাড়ি দেখুন, দেখুন কতখানি কষ্ট পেয়েছি আমি, কতখানি যন্ত্রনার মৃত্যুর হাতে ধরে আমি আত্মসমর্পন করেছি কবিতার কাছে - সব লিখে রাখুন। আমার নিঃসঙ্গতার কবিতায় কার কঠিন নিয়তির মতোন স্থির নিস্তব্ধ মুখ, নিরুত্তাপ হাত? জানিনা কি করে আমার যন্ত্রনা, নারী ও ইশ্বরের সাথে তাবৎ কথোপকথন কবিতায় বিধৃত হবে? হে ঘড়ির কাঁটা, তুমি তো টিকটিকটিকটিকটিক - একটু জিরোও - আমাকে একটু সময় দাও, আমি কবিতার সাথে একটু সময় ঘুমোবো... হে আমার নিঃসঙ্গতা! আমার আত্মা! আমার পবিত্রতা! আমার পূণ্য! আমার পাপ! আমার ঈশ্বর! আমার কবিতা। '
(আমার কবিতা / অনুবাদ: কুঙ্গ থাঙ )
সরল অথচ অর্থময় এক প্রান্তিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটে চলে ধনঞ্জয়ের কবিতায়-
'আমরা যেদিন জলের কাছে গিয়েছিলাম, জল ছিল ঘুমে। ঘুম ভাঙাতে মায়া হলো বলে স্নান করিনি। আমাদের ওষ্ঠলগ্ন অক্ষরদেরও স্নান দিইনি আমরা। দুঃখটাকে পারলাম না জলাঞ্জলি দিতে।
আমাদের হাতে কে তুলে দিয়েছে এই ত্রিতাপ। আমার শুদ্ধ নই। আমরা তাই কোনকিছু উৎসর্গ করতে অক্ষম এখনো। হে শালপ্রাংশু আকাশ, তোমার পায়ের তলে মরার ভাগ্য নিয়ে জন্মানো এই পোঁকাপিপড়ের জীবন নিয়ে আমরা কী করবো, বলে দাও।'
(বলে দাও / অনুবাদ: শুভাশিস সিনহা )
কবিতায় এক নির্মোহ দার্শনিকতায় তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন এবং আহ্বান করেন-
'পথকে মালা পরিয়ে দাও
ওই পথের গর্ভ থেকে আমাদের জন্ম হয়েছিল।'
(পথ / অনুবাদ: শুভাশিস সিনহা )
এভাবে নতুন চিন্তা, নতুন কাব্যবীক্ষা, বৈশ্বিক চেতনার সাথে জাতিগত ঐতিহ্য ও অনুষঙ্গের শৈল্পিক সংশ্লেষ নিয়ে তাঁর কাব্যসাধনা এগিয়ে চলে।
ধনঞ্জয়ের কবিতা দুঃখময় । কবি নিজেও স্বীকার করেন, কি করব যখন, কবিতা লিখি তখন দুঃখ এসে পাশে বসে থাকে । দুঃখকে কবি নতুন রূপে আবিষ্কার করে চলেন কবিতায়, হৃদয় তোলপাড় করে দেয় সে দুঃখ। যেমন -
'শূণ্যে একটি শব্দকে বললাম-
যাও, পদ্ম হয়ে ফোটো।
একজন নারীকে বললাম- যাও,
তার পাশে চন্দ্রকলার ভঙিমায় দাঁড়িয়ে থাকো।
মুখে তোমার ঝরে পড়ুক টলটল করা
একবিন্দু অশ্রুজল।
সে ঢেউয়ে স্মৃতির মত তিরতির কাঁপবে
পদ্ম।
হে পদ্ম! তোমার নাম কি?
বিষাদের মাঝে সে মুচকি হেসে বলে,
আমার নাম দুঃখ। আমাকে চেননা !
আশৈশব তোমার সখা হয়ে আছি যে। '
(দুঃখ / অনুবাদ: কুঙ্গ থাঙ)
কিংবা স্বপ্ন ও স্মৃতির সাথে বাস্তবতা ও বেদনার অবধারিত এই সংঘাত মনকে আচ্ছন্ন করে দেয় -
'কণ্ঠকে বললাম -চারদিক খুঁজে খুঁজে খবর নিয়ে এসো
কিছুক্ষন পর প্রতিধ্বনি ফিরে এলো
বলল, রোদ-বৃষ্টি-বরিষা-শরৎ-সকাল-বিকাল সবদিকে নিয়েছি
চাঁপাগাছে একটিমাত্র ফুল
শৈশবের সাথে স্মৃতির সাঁকো হয়ে আছে।
ওইদিকে পার হয়ে দুরে একটি দ্বীপ নিয়ে দেখলাম
কতদিন কতযুগ কত জন্মের স্বপ্নকে
এক আশ্চর্য গন্ধ পাহারায় রেখেছে
নিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞানটুকু হারিয়ে
পরিচয় দিতে পারলাম না
যদিও পেয়েছি, এক অন্যকে চেনা হলো না
কেউ কারো কথা পারলাম না বুঝতেই
প্রতিধ্বনি হাহাকার করে বলল -
কেন আমাকে ওই পথে পাঠিয়েছিলে!'
(খবর / অনুবাদ: শুভাশিস সিনহা )
ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পয়তাল্লিশ, এরমধ্যে কাব্যগ্রন্থ প্রায় তিরিশটি । কালিদাসের 'মেঘদুত'সহ নানান ভাষার কবিতার অনুবাদ করেছেন মাতৃভাষায়। ১২০টি জাপানি হাইকু কবিতার সংকলন 'মিকুপর চেরিফুল'। বিশ্বের প্রায় ৬০টি ভাষার কবিতার বিপুল কাব্যসম্ভার নিয়ে লেখা 'অনুবাদকল্প' তার অনবদ্য কীর্তি। ছন্দ নিয়ে বই লিখেছেন, লিখেছেন মাতৃভাষার উপর ব্যাকরন। লিখে যাচ্ছেন অবিরত। নিজেকে অতিক্রম করে চলেছেন ক্রমাগত । সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নতুন কবিতার বই, 'জলছিটা না পানিছিটা'। সেখান থেকে আরেকটি কবিতা তুলে ধরলাম -
রাতিহানর বুকগৎ গাছ আকজার রুয়া দেছিলু৷
ঔজার ডাঙর অয়া ডেঙপাল সালকরিয়া
রাতিহানরে গুরে বেলাছে বুলিয়া
মানুয়ে য়ারি দিতারা ।
মি বাসেয়া আছুতাই
ঔজারে কিতা ধরতইতা চেইঙ বুলিয়া
না ফল না দরিয়া
ইমে ছেয়াগ অয়া থায়তইতা ?
রাতের বুকে একটা গাছ লাগিয়েছিলাম৷
লোকজন বলছে
গাছ নাকি বড় হয়ে ডালপালা মেলে
রাতকেই ঢেকে ফেলেছে !
আমি আবার অপেক্ষা করে আছি
ঐ গাছে কি ধরে তা দেখার জন্য
আদৌ কি ফল ধরবে,
নাকি এমনই থাকবে, ছায়া হয়ে ?
( অনুবাদ: কুঙ্গ থাঙ)
বাংলা কাব্যসাহিত্যে ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের সাফল্যও প্রশ্লাতীত । বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে তাঁকে অন্যতম প্রধান বিবেচনা করা হয়। বাংলায় দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।
( ১ ) ত্রাণ শিবির
( ২ ) ভিখারী বালকের গান। প্রবন্ধের বই --ছন্দের কারিগরি।
এর বাইরে তিনি একজন বড় মাপের রবীন্দ্র গবেষকও । সম্পাদনা করেছেন রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ--উত্তরা।
নিত্য অভিজ্ঞতার মোড়কে প্রাত্যহিকের নানা বৈপরীত্য মেলে তাঁর বাংলা কবিতায় । যেমন -
'শব্দ, অর্থ, উপমা উৎপ্রেক্ষা আর বাকপ্রতিমার সঙ্গে
মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়।
নার্সিংহোমের দরজায়, ডাক্তারের ভিড়ঠাসা
চেম্বারের মোমের আলোয়।
ম্লান হাসি বলে দেয় ওরা কেউ ভালো নেই।
কি খবর ! এই চলে যাচ্ছে আর কি ।
তবে সুগার অনেকটা হাই, ঘুম কম ।
ই সি জি রিপোর্ট খুব ভালো নয়।
গ্যাস পাও ঠিকমতো! জিনিসের দাম কিরকম
বেড়ে যাচ্ছে ।
ছেলেরা কি করছে , তোমাদের টি ভি তে বাংলাদেশ
কি রকম পাও ?
কালকের খবর শুনেছ?দিন দিন কি হচ্ছে এ সব ?
এ রকম আলাপের পর অনিবার্য — চলি, দেখা হবে।
দেখা হয়ে কি হবে এখন !'
(দেখা হয় / ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ )
শুভ জন্মদিন কবি ব্রজেন্দ্র ।
শুভ জন্মদিন কবি ধনঞ্জয় রাজকুমার ।

Thursday, May 07, 2015

'ইনচাউ' : মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী ঘর



'ইনচাউ' হল মণিপুরিদের ঐতিহ্যবাহী ঘর। সুপ্রাচীন কাল থেকে মণিপুরিদের পুর্বপুরুষেরা ঠিক করে দিয়ে গেছেন তাদের উত্তরসুরিদের থাকার বাসস্থান কেমন হবে। কোথায় উঠান হবে, বারান্দা হবে, কোথায় রান্নাঘর হবে। বাড়ির বয়োজেষ্ট্যরা কোথায় থাকবেন। পুত্র কন্যাদের পুত্রবধুদের শোবার জায়গা কোথায় হবে। এমনকি বিয়ের পর মেয়েরা বাপের বাড়ি বেড়াতে এলে কোথায় থাকবে সে জায়গাও ঠিক করা আছে ।
ইনচাউ একটি অদ্ভুত সুন্দর ও সুষমভাবে সাজানো স্থাপত্যকর্ম । মুলত প্রাচীন ধর্মের দেবতাদের উপাসনাস্থলের উপর ভিত্তি করে পুরো ঘরটির নকশা সাজানো হয়েছে। মুল ঘরের একেবারে ডানদিন ঘেঁষে 'ফামেলকা' যেটি গৃহকর্তার জন্য বরাদ্দ। একেবারে পেছনের ঘরে যেখানে ধানের গুদাম সেখানে থাকেন সনামাহি, দেবরাজ সরালেলের পুত্র। তার পাশেই গিথানিপুঙ বা লৈমারেন । ঘরের একদম মাঝখানে ফুংগা বা ফায়ারপ্লেস থাকে। ওখানে দেবতারা মাঝে মাঝে এসে বসেন। রান্নাঘরের আগুনটি এখান থেকে নেয়াই নিয়ম। ইনচাউ ঘরটি সেহিসাবে দেবগৃহের মর্যাদা প্রাপ্ত। তাই যেকোন কারণে ঘরের কোন অংশ অপবিত্র হলে পুরো ঘরটি লেপামুছা করতে হয়, কাপড়চোপড় থালাবাসন নতুন করে ধুতে হয়। ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়ান ধ্বংসকারী দেবতা পাহাংপা। সেকারণে বাড়ির আশপাশটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হয় । যেকোন মণিপুরি বসতিতে গেলে এজন্য সবার আগে পরিচ্ছন্নতা চোখে পড়ে ।
কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী এই ইনচাউ ঘর প্রায় বিলুপ্ত হবার পথে । মণিপুরি বসতিতে দু'একটা ঘর কদাচিৎ চোখে পড়ে। তার জায়গা নিয়েছে টিনশেড ঘর। কোথাও পাকাঘর। কোথাও দালানকোঠা। কিন্তু এখনও মণিপুরিদেরকে পুরোনো প্যাটার্নটি মেনেই ঘর তৈরি করতে হয় । ফামেলকা নিঙলকা গিথানিপুঙ সব ঠিক রেখেই বাড়ি বানাতে হয় ।
মণিপুরিদের ইনচাউ ঘর রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ছাত্র উজ্জ্বল সিংহ। ইনচাউ ঘরের পুরোনো প্যাটার্ন ও ঐতিহ্যিক উপাদানসমুহ ঠিক রেখে তিনি ডিজাইন করেছেন নতুন শতাব্দীর আধুনিক ইনচাউ ঘর। আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে সঙ্গতি রেখে দোতলা ইনচাউ ঘরে যোগ করেছেন আরো কিছু অনুসঙ্গ- অধিক পরিসর, ভেন্টিলেশন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা, পয়ব্যবস্থা, ড্রেনেজ। তার ডিজাইনটি ইতিমধ্যে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে 'Rethinking INCHAO: The heritage of Manipuri Dwelling' আন্ডারগ্রাজুয়েট থিসিস হিসাবে প্রদর্শিত এবং প্রশংসিত হয়েছে। ডিজাইনটি নিয়ে বিস্তারিত একটা পোষ্ট লেখার ইচ্ছা থাকল ।
উজ্জ্বলের জন্য অসংখ্য শুভকামনা ।
[ ১ম ছবিটি ট্রেডিশনাল মণিপুরি ইনচাউ ঘরের ডিজাইন। ২য় ছবিতে ইনচাউ ঘরের আধুনিক ডিজাইন। ]

Sunday, October 12, 2014

ধনঞ্জয় রাজকুমার তার 'লিকসই' কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন কুঙ্গ থাঙকে

 বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার স্বনামখ্যাত কবি ধনঞ্জয় রাজকুমার তার একটি কাব্যগ্রন্থ আমাকে উৎসর্গ করেছেন । কাব্যগ্রন্থের নাম 'লিকসই' । প্রকাশক পৌরি । প্রকাশকাল ১ অক্টোবর ২০১৪ । উৎসর্গপত্রে কবি ধনঞ্জয় রাজকুমার আমার নাম উল্লেখ করে লিখেছেন, কনাক গবেষকরে বানা'ল, মানে তরুন গবেষককে ভালবাসাসহ । আমি খুবই গৌন একজন লেখক । বড় কোন গবেষনাকর্মও আমার নাই । লেখা বলতে মাতৃভাষায় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রবন্ধ, বাংলা ইংরেজী ও মাতৃভাষায় লেখা কিছু ব্লগ আর উইকিপিডিয়ার কয়েকটি নিবন্ধ । বাংলাদেশের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি লেখকদের তালিকায় কখনও আমার জায়গা হয়না । এতবড় একজন কবির কাছ থেকে শুনে নিজেকে এখন গবেষক গবেষক লাগছে । 

Thursday, August 22, 2013

মণিপুরিদের বিষু উৎসব

কাল থেকে শুরু হবে মণিপুরীদের বর্ণাঢ্য বিষু উৎসব। বাংলাদেশের মৌলবীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার মণিপুরী বসতিগুলোতে চৈত্র মাসের শেষ দিন থেকে সাতদিন ব্যাপী এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবের মাধ্যমে পুরাতন বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। সংস্কৃত "মহাবিষুব" শব্দ হতে "বিষূ" শব্দটির উৎপত্তি বলে ধারন করা হয়। কারো কারো মতে "দ্বিষু" অর্থ্যাৎ যেদিন বিষুবরেখা সূর্যালোক দ্বারা দ্বিধাবিভক্ত হয় সেই দিনটি বিষু। যাহোক মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়ারা যে দিনটিকে "বিষু" বা "চেরৌ" হিসাবে পালন করে, মণিপুরী মৈতৈদের কাছে সেদিনটি "শাজিবু চৈরাউবা", চাকমাদের কাছে "বিঝু", মারমাদের নিকট "সাংগ্রাই", ত্রিপুরাদের "বৈসুক" এবং অসমীয়াদের "বিহু" এবং বাঙালীদের কাছে "চৈত্র সংক্রান্তি"।

বছরের শেষ দিনটিতে মণিপুরীরা সুর্যোদয়ের আগেই ঘরদোর, ঘরের চারপাশ এবং ঘরের যাবতীয় ব্যবহার্য বস্ত্রআসবাবপত্র পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ সেরে ফেলে। স্নানের পর রান্নাবান্না শুরু হয়। শুধুমাত্র নিরামিষ রান্না অসংখ্য পদের। এরপর লৌকিক দেবতা "আপোকপা" এবং কুলদেবতা "লামরদৌ"এর উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদনের পর চলে সম্প্রীতির নিদর্শন হিসাবে ঘর থেকে ঘরে রান্না করা খাবার বিনিময়ের পালা। সন্ধ্যায় তৈরী হয় নানান জাতের পিঠা। মণিপুরী লেইসাঙ বা মন্দিরগুলো আরতি, পালা, কীর্তন ও মৃদঙ্গের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে। কোথাও কোথাও বসে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য এবং গানের আসর। রাতভর চলে তরুণ তরুনীদের ঐতিহ্যবাহী নিকন (বিশেষ ধরনের পাশা), গিল্লা, লাকাটি ইত্যাদি নানান খেলা।

বিষুর আভিধানিক অর্থ সাম্য বা সমতা। দিনরাত্রির দৈর্ঘ্যের সমতা মনিপুরী জীবনধারায় এসে সামাজিক সংহতি ও সাম্যের রূপ নিয়েছে। বিষু সবার দু:খ-কস্ট আনন্দ-বেদনা হতাশা-বঞ্চনা ভাগাভাগি করার দিন। ভারতবর্ষের পশ্চিমে পাঞ্জাবে "বৈশাখী" উৎসব, দক্ষিনে কেরালায় গিয়ে "ভিজু", এরপর দেড়হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বাঙালীর "চৈত্র সংক্রান্তি", আসামে এসে অসমীয়াদের "বিহু", মণিপুরী বিষ্ণুপ্র্রিয়াদের "বিষু", চাকমাদের নিকট "বিঝু" এবং ত্রিপুরীদের নিকট "বৈসুক" হবার নেপথ্যে কারণ কি কাকতালমাত্র? তবে কি সুদুর অতীতে ইতিহাসের কোন এক সময়ে এইসব জাতিগোস্টির পুর্বপুরুষদের মধ্যে কোনরূপ পারস্পরিক নৈকট্য বা যোগাযোগ ছিল?

লৌকিক দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ

লৌকিক দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা

বিষূর দিনে বিভিন্ন পদের রান্না

বিষুর দিনে মণিপুরী নৃত্য ও সংগীতের আসর

মণিপুরী মন্দিরে পালাকীর্ত্তনের আসর

ঐতিহ্যবাহী নিকন খেলা নিয়ে রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহের পেইন্টিং

Wednesday, March 27, 2013

আজ য়াওশাঙ । লেইশাঙ জন্ম ।




আজ য়াওশাঙ। দোলপূর্ণিমার মণিপুরি সংস্করণ। মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়ারা এই উৎসবকে ‘জন্ম’ বা ‘লেইশাঙ জন্ম’ও বলে থাকে। মণিপুরিদের হোলি হিন্দুদের থেকে অনেকখানি ভিন্ন। য়াওশাঙ এখন মণিপুরি বৈষ্ণবদের কৃত্য হলেও এর প্রচলন মণিপুরিদের হিন্দুধর্মের বলয়ে আসার অনেক আগে থেকেই। তখন উৎসবটি শীতকালের বিদায় এবং বসন্ত কালের আগমনবার্তা বয়ে নিয়ে আসতো।
য়াওশাঙ উৎসব চলে পাঁচদিনব্যাপী। প্রথম দিনটিতে বাঁশ, কাঠ এবং খড়ের ছাউনি ব্যবহার করে ছোট আকৃতির চালাঘর বা লেইশাঙ বানানো হয়। পুজাশেষে লেইশাঙে আগুন দেয়া হয়। লেইসাঙের পবিত্রভস্ম ও ছাই সবাই নিজ নিজ কপালে মাখে এবং বাড়ীতে নিয়ে যায়। লেইসাঙ জন্মের দ্বিতীয় দিনটি থেকে মুল উৎসব শুরু। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে নানান বয়সের মানুষ কাঁধে ঝুলি ঝুলিয়ে অথবা চটের ব্যাগ, বালতি হাতে করে একে অন্যের বাড়ীতে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ভিক্ষা করতে বের হয়। যারা ভিক্ষা করে তারা সমস্বরে সুর করে “মহাপ্রভূর জন্ম হরি হরি বোলা – এ হরি”, “হরি বোলা – এ হরি” ধ্বনি উচ্চারন করতে করতে এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীর সীমানায় প্রবেশ করে। ভিক্ষা হিসাবে মুলত চাল দেয়া হয়, অনেকে ফলমুল ও নগদ টাকাও দিয়ে থাকে। ভিক্ষার দলগুলো একে অন্যের মুখোমুখি হলে একে অন্যের মুখে রঙ মাখিয়ে দেয়।
য়াওশাঙের দিনগুলোতে মণিপুরি মৈতৈদের ঐতিহ্যবাহী থাবাল-চোঙবা নৃত্যের পরিবেশনা চলে । ‘থাবাল’ মানে চন্দ্রালোক, ‘চোঙবা’ মানে লাফ। চাদেঁর আলোয় একে অন্যের হাত ধরে লাফ দিয়ে নাচার ঐতিহ্যটি ২০০০ বছরের পুরোনো। মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়ারা মন্দিরা করতাল মৃদঙ্গ ও ঢোল সহযোগে ভ্রাম্যমান নৃত্যগীতের দল বা হোলি বের করে। গভীর রাত পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে হোলির দলগুলো গান পরিবেশন করে থাকে। হোলির বেশীর ভাগই ব্রজবুলি ও বাংলা ভাষায়য় লেখা। গানগুলিতে মুলত বসন্তের প্রকৃতিবর্ণন ও কৃষ্ণ-গৌরাঙ্গ তত্ত্ব বর্ণনা করা হয়। যেমন-
বসন্ত আগত বৃন্দাবনমত
বিহরহী রসিকমুরারী
মানেনা মানেনা মনে
মন করে উচাটন
উচাটন করে কিবা রঙ্গে
কিংশুক সারিশুক পরিসুখ নবসুখ..
সবাইকে য়াওশাঙ উৎসবের শুভেচ্ছা। দোলের আবিরে ঘুচে যাক জগতের সমস্ত অন্ধকার।