পাঠ্যবইতে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যাবলীর সমাবেশ ঘটানো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য প্রধান দিক। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক র্বোড বলে আমাদের একটি সংস্থা আছে যেটি নানান সরকারের আমলে নানানরূপে এই আকামটি করে থাকে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত পঞ্চম শ্রেণীর ‘পরিবেশ পরিচিতি সমাজ’ এবং নবম ও দশম শ্রেণীর ‘English for Today’ পাঠ্যবইতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সীমানায় বসবাসরত মণিপুরী জনগোষ্ঠি সমন্ধে একগাদা ভুল ও বিকৃত তথ্য দেওয়া হয়েছে। এসব পাঠ্যগুলোতে আদিবাসী মণিপুরী জনগোষ্ঠির প্রধান ও বৃহত্তম শাখা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সম্পুর্নরূপে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। উপরন্তু মণিপুরীদের জীবনধারা, ভাষা ও সংস্কৃতি সমন্ধে যেভাবে ভিত্তিহীন, খন্ডিত এবং ত্রেবিশেষে মনগড়া ও হাস্যকর তথ্যের অবতারনা করা হয়েছে, রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক এবং একজন মণিপুরী হিসাবে তা আমার অনুভূতিকে গভীরভাবে আহত করেছে।
মণিপুরীরা বাংলাদেশের একটি অনগ্রসর ও অবহেলিত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। সিলেট বিভাগের এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠি সমৃদ্ধ ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারি হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যালঘুতা ও অনগ্রসরতার কারণে বিগত সরকারগুলোর আমলে উপোক্ষ ও অবহেলার শিকার হয়েছে। উল্লেখ্য, বিগত ২০০০ সনে পাঠ্যপুস্তকে মণিপুরীদের সমন্ধে ভুল তথ্য সংশোধনের জন্য আমার একটি আবেদন দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক প্রথম আলো এবং দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কালে মণিপুরীদের প্রতিনিধিত্তকারী বিভিন্ন সংগঠন তৎকালীন আওয়ামী লীগ এবং বিগত বিএনপি সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে স্মারকলিপি প্রদান করে প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু আজ অবধি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা শিক্ষা মন্ত্রনালয় এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি। আদিবাসি জনগোষ্ঠি হিসাবে সরকার প্রদত্ত শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধাদি একচ্ছত্রভাবে ভোগ করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লালিত একটি বিশেষ মহলের অপতৎপরতা এর মুল কারণ বলে মণিপুরীরা মনে করছে। পাঠ্যপুস্তকসহ অন্যান্য সরকারি প্রকাশনা এবং প্রচারমাধ্যমে মণিপুরীদের সম্বন্ধে উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে ভুল এবং পপাতদুস্ট তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করার উদ্দেশ্য জনমানসে মণিপুরী পরিচিতি নিয়ে বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃস্টির এই অশুভ তৎপরতা বন্ধ হওয়া জরুরী এটাই কাম্য।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ঢাকা থেকে প্রকাশিত পঞ্চম শ্রেণীর ‘পরিবেশ পরিচিত সমাজ’ পাঠ্যবইটির রচনায় ড. সাবিহা সুলতানা, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, সেলিনা আক্তার ও লুৎফুর রহমান এবং সম্পাদনায় প্রফেসর মোহাম্মদ আলতাফ হোসেনের নাম রয়েছে। অন্যদিকে নবম ও দশম শ্রেণীর ‘English for Today’ বইটির রচয়িতা হিসাবে নায়না শাহজাদী, ফজলে রাব্বানী ও শামীমা তাসমিন এবং সম্পাদক হিসাবে এম. এস. হক এর নাম রয়েছে। কোন জাতিসত্তা, তাদের জীবনধারা, ভাষা বা সংস্কৃতির মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে চর্চা করার পুর্বে পর্যাপ্ত গবেষনা ও মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু অত্যন্ত দু:খের বিয়য় যে উপরোক্ত দুইটি পাঠ্যবই রচনার ক্ষেত্রে মাঠপর্য়ায়ে কোন তথ্য সংগ্রহ বা গবেষনার ধারা অনুসরন করা হয়নি। পঞ্চম শ্রেণীর ‘পরিবেশ পরিচিত সমাজ’ পাঠ্যবইটির ‘বিশ্বের বিভিন্ন জাতি’ শীর্ষক ষোলতম অধ্যায়ের ১৪৩, ১৪৪ ও ১৪৫ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘মণিপুরী’ শিরোনামের লেখাটিতে বাস্তবের সাথে সংগতিহীন তথ্যের অবতারনা করা হয়েছে। যেমন -
(১) ‘এদের আদি বাসস্থান আসামের মণিপুর রাজ্যে।’
প্রকৃতপে মণিপুর ভারতের উত্তর-পুর্বাঞ্চলের একটি স্বতন্ত্র রাজ্য (২৩.৫º-১৫.৩º উত্তর আংশ থেকে ৯৩.১º -৯৪.৩º পুর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং আয়তন ২২, ৩২৭ বর্গ কি.মি.); এর রাজধানীর নাম ইম্ফাল। মণিপুর আসামের অন্তর্গত নয়; আসাম হলো মণিপুরের সীমান্তবর্তী আরেকটি ভিন্ন রাজ্য এবং এর রাজধানী দিসপুর।
(২) ‘তাদের গায়ের রং ফর্সা, চোখ ছোট, নাক কিছুটা চ্যাপ্টা, উচ্চতা মাঝারি।’
প্রকৃতপে মণিপুরীদের সবার গায়ের রং ফর্সা নয়,সবার চোখ ছোট বা সবার নাক চ্যাপ্টাও নয়। মণিপুরীদের মুখাবয়বে একইসাথে অনার্য্য ও আর্য্য বৈশিষ্ঠ্য ল্য করা যায়। মণিপুরীদের মধ্যে তিনটি শাখা রয়েছে - (১) বিষ্ণুপ্রিয়া, (২) মৈতৈ ও (৩) পাঙন। বিষ্ণুপ্রিয়ারা ককেশয়েড মহাজাতির আর্য-ভারতীয় সাব-ফেমিলির অšতর্গত এবং তাদের দৈহিক গড়ন মিশ্র আর্য ও ভোটব্রহ্মী । মৈতৈরা মঙ্গোলয়েড মহাজাতির টিবেটো-বার্মান সাব-ফেমিলির অšতর্গত এবং তাদের দৈহিক গড়ন মিশ্র মঙ্গোলীয়। পাঙনরা পাঠান বংশদ্ভুত।
(৩) ‘বিয়েতে ছেলেমেয়েরা একত্রে দেবতাকে খুশী করার জন্য নৃত্য পরিবেশন করে।’
মণিপুরীদের বিবাহ অনুষ্ঠানটি অনুসরন করা হয় প্রাচীন মণিপুরী রীতির সাথে বৈদিক প্রাজপাত্য বিবাহরীতির সমন্বয় ঘটিয়ে। পরিচিতি, লগ্ন নির্ধারন ও আপ্যায়নের জন্য বিবাহের পুর্বে ‘ওয়ারৌপৎ’ ও ‘হেইজাপৎ’ নামে দুটি অনুষ্ঠান থাকে। বিবাহের দিন বৈষ্ণব রীতি অনুসারে পুরুষ পালাকার ও মৃদঙ্গ বাদকদের পরিবেশনায় বৈষ্ণব পালাকীর্ত্তন পরিবেশিত হয়, এর বাইরে কোন প্রকারের নাচের অনুষ্ঠানের অবকাশ নেই। পরে পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ এবং বরকে ঘিরে কনের সপ্ত-প্রদক্ষিনের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
(৪) ‘পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য তারা নদীর ধারে বাড়ি নির্মান করে।’
মণিপুরীরা পাহাড়ের অধিবাসী বা অরণ্যচারী নয়, তারা সমতলের বাসিন্দা। পুর্বপুরুষদের বিধান অনুসারে তারা বাড়ীর চারদিকে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে বসতবাড়ি নির্মাণ করে থাকে এবং এই বসতবাড়ী নির্মাণের সাথে নদীর অবস্থানের কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া নদীর দুষিত পানি কোন আনুষ্ঠানিক বা গৃহস্থালী কাজে মণিপুরীরা ব্যবহার করেনা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের পাশ দিয়েই কোন না কোন নদী বয়ে চলেছে, এক্ষেত্রে আলাদাভাবে মনিপুরীদের বসতবাড়ীর সাথে নদীর অবস্থান খুঁজে বেড়ানো বাহুল্যমাত্র।
(৫) ‘মণিপুরীদের নিজস্ব কোন ধর্ম নেই।’
মণিপুরীদের নিজস্ব লৌকিক ধর্মের নাম ‘আপোকপা’ যা অত্যন্ত প্রাচীন, আধ্যাত্তিকতায় গভীর ও দার্শনিকভাবে উচ্চস্তরের। প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা নিজের প্রতিকৃতি থেকে মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিটি মানুষ সৃস্টিকর্তার একেকটি ছায়া। এখনো মণিপুরী মৈতৈদের অনেকে এই ধর্মের অনুসারী। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের একাংশের মধ্যের ‘আপোকপা’ পুজার প্রচলন রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরীরা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়।
(৬) ‘রাধা, কৃষ্ণ, বিষ্ণু, গৌড়াঙ্গ এদের প্রধান দেব দেবী।’
মণিপুরীরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী সেকারণে রাধা ও কৃষ্ণ এদের পরমারাধ্য। এছাড়া হিন্দুধর্মের পৌরাণিক দেব দেবীর মধ্যে বিষ্ণু, দুর্গা, শিব, স্বরসতী ও লীর পুজা মণিপুরীরা করে থাকে; গৌরাঙ্গ কোন দেব বা দেবী নন, তিনি গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা মহাপুরুষ। এছাড়া মণিপুরীদের লৌকিক দেব দেবীর মধ্যে সরালেল, সনামাহি, পাখাঙবা, ইমাগিথানী ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য।
(৭) ‘মণিপুরীদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা আছে। এই ভাষাকে বলা হয় মেথেয়ী।’
মণিপুরীদের মধ্যে দুইটি ভাষা প্রচলিত - মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈ (‘মেথেয়ী’ নয়)। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার উপর গবেষনা ও সংরনকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ঝওখ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ বাংলাদেশের ৩৯টি ভাষার মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ ভাষাকে তালিকাভুক্ত করেছে এবং উভয় ভাষার জন্য ওঝঙ ৬৩৯-২ খধহমঁধমব পড়ফব বরাদ্দ করেছে। এছাড়া দুইটি ভাষাই ভারতে স্বীকৃত লাভ করেছে এবং ভারত সরকার মণিপুর, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের স্কুলগুলোতে মণিপুরী মৈতৈ ও মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া উভয় ভাষায় শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ করে দিয়েছে। উভয় ভাষারই প্রাচীন বর্ণমালা থাকলেও বর্তমানে মুদ্রন ও প্রকাশনার কাজে বাংলা অর ব্যবহৃত হয়।
অপরদিকে নবম ও দশম শ্রেণীর ‘English for Today ’ পাঠ্যবইটির ১৭৮ ও ১৭৯ নং পৃষ্ঠায় মণিপুরীদের বিবাহ অনুষ্ঠান নিয়ে সম্পুর্ণ কল্পিত, ভিত্তিহীন ও মনগড়া তথ্য দেওয়া হয়েছে যা মণিপুরীদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে শিক্ষার্থীদের মনে হাস্যকর ধারনা সৃষ্টি করবে। উল্লেখিত পাঠ্যবইয়ের একটি কমপোজিশনে মণিপুরীদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে -
The Monipuris want to … future by the sign and … marraige, they …. predict the future by interpreteing the … of the cock... is a Monipuri proverb: En Khang Tam Nau Bau, meaning all wisdom … cocks's foot...যার সারমর্ম হলো মনিপুরীদের বিয়ের অনুষ্ঠানটি বড়ই অদ্ভূত... বিয়ের আগে মণিপুরী বরকনের উঠানে মুরগীর পা রশি দিয়ে বেঁধে বিভিন্ন ধরনের খেলা দেখানো হয়... এবং এভাবে বিবাহের শুভাশুভ নির্ণয় করা হয়। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো বইটিতে এই বিষয় নিয়ে রীতিমতো একটি প্রবচন রচনা করে তা মণিপুরীদের বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রথমত: মণিপুরীদের বিবাহের মধ্যে ‘মুরগীর পায়ে রশি বাঁধা’ জাতীয় ব্যাপার নেই। এ ধরনের ঘটনার কোন বিবরন বা অস্তিত্ত্ব মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া বা মণিপুরী মৈতৈদের প্রাচীন কোন লোকাচার, লোকসাহিত্য বা মিথলজিতেও পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত: মণিপুরীদের মধ্যে হাঁস, মুরগী বা ছাগল পালনের প্রচলন নেই। গৃহপালিত জীবজন্তুর মধ্যে মণিপুরীরা প্রধানত গরু বা মহিষ পোষে থাকে কৃষিকাজের জন্যে।
তৃতীয়ত: একমাত্র মণিপুরী পাঙনদের মধ্যে হাঁস, মুরগী বা ছাগল পালনের প্রচলন রয়েছে কিন্ত তারা ইসলাম ধর্মাবালম্বী হওয়ায় তাদের বিবাহ মুসলিম শরীয়ত অনুযায়ী সম্পন্ন হয়ে থাকে, যেখানে মুরগী বা কোন জীবজন্তু নিয়ে এরকম হাস্যকর ক্রিয়ানুষ্ঠানের স্থান নেই।
চতুর্থত: মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া বা মণিপুরী মৈতৈ ভাষায় “এন খঙ তাম নাউ বাউ” নামে কোন প্রবাদ/প্রবচন নেই, এমনকি মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া বা মণিপুরী মৈতৈ ভাষায় শব্দকোষে ‘এন’, ‘খঙ’, ‘তাম’, ‘নাউ’ বা ‘বাউ’ বলে কোন শব্দ নেই।
তদুপরি উপরোক্ত পাঠ্যবইতে ‘মণিপুরী’ বানানটি ভুলভাবে ‘Monipuri’ লেখা হয়েছে যার অনুমোদিত ও প্রকৃত ইংরেজী বানান হবে ‘Manipuri ।
No comments:
Post a Comment