Thursday, August 22, 2013

মণিপুরিদের বিষু উৎসব

কাল থেকে শুরু হবে মণিপুরীদের বর্ণাঢ্য বিষু উৎসব। বাংলাদেশের মৌলবীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার মণিপুরী বসতিগুলোতে চৈত্র মাসের শেষ দিন থেকে সাতদিন ব্যাপী এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবের মাধ্যমে পুরাতন বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। সংস্কৃত "মহাবিষুব" শব্দ হতে "বিষূ" শব্দটির উৎপত্তি বলে ধারন করা হয়। কারো কারো মতে "দ্বিষু" অর্থ্যাৎ যেদিন বিষুবরেখা সূর্যালোক দ্বারা দ্বিধাবিভক্ত হয় সেই দিনটি বিষু। যাহোক মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়ারা যে দিনটিকে "বিষু" বা "চেরৌ" হিসাবে পালন করে, মণিপুরী মৈতৈদের কাছে সেদিনটি "শাজিবু চৈরাউবা", চাকমাদের কাছে "বিঝু", মারমাদের নিকট "সাংগ্রাই", ত্রিপুরাদের "বৈসুক" এবং অসমীয়াদের "বিহু" এবং বাঙালীদের কাছে "চৈত্র সংক্রান্তি"।

বছরের শেষ দিনটিতে মণিপুরীরা সুর্যোদয়ের আগেই ঘরদোর, ঘরের চারপাশ এবং ঘরের যাবতীয় ব্যবহার্য বস্ত্রআসবাবপত্র পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ সেরে ফেলে। স্নানের পর রান্নাবান্না শুরু হয়। শুধুমাত্র নিরামিষ রান্না অসংখ্য পদের। এরপর লৌকিক দেবতা "আপোকপা" এবং কুলদেবতা "লামরদৌ"এর উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদনের পর চলে সম্প্রীতির নিদর্শন হিসাবে ঘর থেকে ঘরে রান্না করা খাবার বিনিময়ের পালা। সন্ধ্যায় তৈরী হয় নানান জাতের পিঠা। মণিপুরী লেইসাঙ বা মন্দিরগুলো আরতি, পালা, কীর্তন ও মৃদঙ্গের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে। কোথাও কোথাও বসে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য এবং গানের আসর। রাতভর চলে তরুণ তরুনীদের ঐতিহ্যবাহী নিকন (বিশেষ ধরনের পাশা), গিল্লা, লাকাটি ইত্যাদি নানান খেলা।

বিষুর আভিধানিক অর্থ সাম্য বা সমতা। দিনরাত্রির দৈর্ঘ্যের সমতা মনিপুরী জীবনধারায় এসে সামাজিক সংহতি ও সাম্যের রূপ নিয়েছে। বিষু সবার দু:খ-কস্ট আনন্দ-বেদনা হতাশা-বঞ্চনা ভাগাভাগি করার দিন। ভারতবর্ষের পশ্চিমে পাঞ্জাবে "বৈশাখী" উৎসব, দক্ষিনে কেরালায় গিয়ে "ভিজু", এরপর দেড়হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বাঙালীর "চৈত্র সংক্রান্তি", আসামে এসে অসমীয়াদের "বিহু", মণিপুরী বিষ্ণুপ্র্রিয়াদের "বিষু", চাকমাদের নিকট "বিঝু" এবং ত্রিপুরীদের নিকট "বৈসুক" হবার নেপথ্যে কারণ কি কাকতালমাত্র? তবে কি সুদুর অতীতে ইতিহাসের কোন এক সময়ে এইসব জাতিগোস্টির পুর্বপুরুষদের মধ্যে কোনরূপ পারস্পরিক নৈকট্য বা যোগাযোগ ছিল?

লৌকিক দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ

লৌকিক দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা

বিষূর দিনে বিভিন্ন পদের রান্না

বিষুর দিনে মণিপুরী নৃত্য ও সংগীতের আসর

মণিপুরী মন্দিরে পালাকীর্ত্তনের আসর

ঐতিহ্যবাহী নিকন খেলা নিয়ে রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহের পেইন্টিং

Wednesday, March 27, 2013

আজ য়াওশাঙ । লেইশাঙ জন্ম ।




আজ য়াওশাঙ। দোলপূর্ণিমার মণিপুরি সংস্করণ। মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়ারা এই উৎসবকে ‘জন্ম’ বা ‘লেইশাঙ জন্ম’ও বলে থাকে। মণিপুরিদের হোলি হিন্দুদের থেকে অনেকখানি ভিন্ন। য়াওশাঙ এখন মণিপুরি বৈষ্ণবদের কৃত্য হলেও এর প্রচলন মণিপুরিদের হিন্দুধর্মের বলয়ে আসার অনেক আগে থেকেই। তখন উৎসবটি শীতকালের বিদায় এবং বসন্ত কালের আগমনবার্তা বয়ে নিয়ে আসতো।
য়াওশাঙ উৎসব চলে পাঁচদিনব্যাপী। প্রথম দিনটিতে বাঁশ, কাঠ এবং খড়ের ছাউনি ব্যবহার করে ছোট আকৃতির চালাঘর বা লেইশাঙ বানানো হয়। পুজাশেষে লেইশাঙে আগুন দেয়া হয়। লেইসাঙের পবিত্রভস্ম ও ছাই সবাই নিজ নিজ কপালে মাখে এবং বাড়ীতে নিয়ে যায়। লেইসাঙ জন্মের দ্বিতীয় দিনটি থেকে মুল উৎসব শুরু। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে নানান বয়সের মানুষ কাঁধে ঝুলি ঝুলিয়ে অথবা চটের ব্যাগ, বালতি হাতে করে একে অন্যের বাড়ীতে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ভিক্ষা করতে বের হয়। যারা ভিক্ষা করে তারা সমস্বরে সুর করে “মহাপ্রভূর জন্ম হরি হরি বোলা – এ হরি”, “হরি বোলা – এ হরি” ধ্বনি উচ্চারন করতে করতে এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীর সীমানায় প্রবেশ করে। ভিক্ষা হিসাবে মুলত চাল দেয়া হয়, অনেকে ফলমুল ও নগদ টাকাও দিয়ে থাকে। ভিক্ষার দলগুলো একে অন্যের মুখোমুখি হলে একে অন্যের মুখে রঙ মাখিয়ে দেয়।
য়াওশাঙের দিনগুলোতে মণিপুরি মৈতৈদের ঐতিহ্যবাহী থাবাল-চোঙবা নৃত্যের পরিবেশনা চলে । ‘থাবাল’ মানে চন্দ্রালোক, ‘চোঙবা’ মানে লাফ। চাদেঁর আলোয় একে অন্যের হাত ধরে লাফ দিয়ে নাচার ঐতিহ্যটি ২০০০ বছরের পুরোনো। মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়ারা মন্দিরা করতাল মৃদঙ্গ ও ঢোল সহযোগে ভ্রাম্যমান নৃত্যগীতের দল বা হোলি বের করে। গভীর রাত পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে হোলির দলগুলো গান পরিবেশন করে থাকে। হোলির বেশীর ভাগই ব্রজবুলি ও বাংলা ভাষায়য় লেখা। গানগুলিতে মুলত বসন্তের প্রকৃতিবর্ণন ও কৃষ্ণ-গৌরাঙ্গ তত্ত্ব বর্ণনা করা হয়। যেমন-
বসন্ত আগত বৃন্দাবনমত
বিহরহী রসিকমুরারী
মানেনা মানেনা মনে
মন করে উচাটন
উচাটন করে কিবা রঙ্গে
কিংশুক সারিশুক পরিসুখ নবসুখ..
সবাইকে য়াওশাঙ উৎসবের শুভেচ্ছা। দোলের আবিরে ঘুচে যাক জগতের সমস্ত অন্ধকার।