Monday, October 22, 2018

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের কার্ত্তিকা উৎসব, নিয়মসেবা ও লেইরিক থিকরানি




কোজাগরী পূর্ণিমার ভরা চাঁদের রাত থেকে শুরু হবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের কার্ত্তিকা উৎসব। কার্ত্তিক মাস তাই কার্ত্তিকা। কার্ত্তিক মাসটি নানান কারণে গুরুত্বপুর্ণ। এ মাসের শেষেই মণিপুরি মহারাস। রাস উৎসবের আগে পুরো কার্ত্তিক মাস জুড়ে থাকে উৎসবের আমেজ। মুলপর্বটি "নিয়মসেবা" বা "নিয়মর পালি" নামে পরিচিত। নিয়মপালির সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ দিক হলো পুঁথিপাঠ বা পুরাণ-পাঠ। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় বলা হয় "লেইরিক থিকরানি"। শ্রোতাদের সামনে পুরাণের নির্বাচিত অংশ থেকে সুরেলা আবৃত্তি এবং মাতৃভাষায় তার সরল অনুবাদ ও ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়।
প্রাক-বৈষ্ণব আমল থেকে মণিপুরিদের মধ্যে 'য়ারি' বা গল্পের আসরের প্রচলন ছিল। যারা 'য়ারি' বা গল্প বয়ান করতেন তারা পেশাগতভাবেই এ কাজটি করতেন। কোন গল্পের কাহিনী, ভাব, রস ও চরিত্রের ব্যাখ্যা দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে শৈল্পিক বয়ানভঙ্গির মাধ্যমে উপস্থাপন করতেন তারা- আখ্যানবস্তুটি হয়তো কোন ঐতিহাসিক বা পৌরানিক ঘটনা, বা মিথলজির কোন উপাখ্যান থেকে নেয়া অথবা জীবনঘনিষ্ট কোন গল্পকে ভিত্তি করে তৈরি। এই য়ারি বা গল্পগুলো কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। জীবনঘনিষ্ঠ প্রচলিত 'য়ারি'র মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো 'আপাঙর য়ারি' বা বোকাদের গল্প। গল্পগুলো আসরের বাইরেও ঘরে ঘরে বয়োজেষ্ঠদের দ্বারাও কথিত-চর্চিত হয়ে আসছে। এই গল্পবয়ান বা কথকতা দীর্ঘকাল থেকেই শিল্পরীতি হিসাবে স্বীকৃত। মণিপুরি রাজারা নানান সময়ে এই শিল্প-আঙ্গিকের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সেই পরম্পরায় এখনো মণিপুর রাজ্যে সেরা 'লেইরিক থিবা-হাইবা'দের প্রতিবছর সম্মাননা দেয়া হয়। ষোড়শ শতকের দিকে বৈষ্ণব ধর্মের বলয়ে আসার পর সমগ্র মণিপুরে বৈষ্ণব সাহিত্য এবং হিন্দু পৌরানিক গ্রন্থ বিশেষ করে মহাভারত, রামায়ন ইত্যাদি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তখন পুথিঁপাঠের আংগিকেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
মণিপুরিদের এই পুরাণ-পাঠ বা আবৃত্তির বিশেষ একটি ঢঙ আছে, যা বাঙালিদের পুঁথিপাঠ থেকে একেবারেই ভিন্ন। পরিবেশনাটি একক বা দ্বৈত হতে পারে। একক পরিবেশনার ক্ষেত্রে যিনি পাঠ করেন তিনিই ব্যাখ্যা দেন। দ্বৈত রীতিতে দুজন পরিবেশক থাকেন- যিনি পাঠ করেন তাকে বলা হয় "থিপা", আর যিনি ব্যাখ্যাদান করেন তাকে বলা হয় "য়ারিলিপা"। থিপা আর য়ারিলিপার মিলিত পরিবেশনায় দর্শক শ্রোতাকে কখনো ভাবাবেগে অশ্রুসজল হতে দেখা যায়, আবার কখনো হাসিতে ঢলে পড়তে দেখা যায়। এভাবে শ্রোতা-দর্শকের সাথে সার্বক্ষণিক সমঝোতা ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে 'লেইরিক থিকরানি' এগিয়ে যায়। পুরাণ-পাঠকদের সবচেয়ে বড় গুণ বিষয়ের পুনর্নির্মাণ। প্রতিবার বিষয় তো সেই পুরাতন- তারই বিভিন্ন অংশ ভেঙে নিয়ে সময়োপযোগী করে দর্শকদের আনন্দ দেওয়া এবং সেইসঙ্গে চলে তলে তলে লোকশিক্ষা।
পুঁথিপাঠ শেষ হলে ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র সহযোগে বৈষ্ণব পদাবলী বা আরতি গাওয়া হয়। কখনও আয়োজন করা হয় কার্ত্তিকের ঐতিহ্যবাহী মৃদঙ্গবাদনের প্রতিযোগিতা "কার্ত্তিকর ফান্না"। সবশেষে ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরন করা হয়। প্রসাদের মধ্যে থাকে গুড়ের সাথে খই বা মুড়ি মিশিয়ে ঘরে তৈরী 'কাবক' বা 'লারৌ', বিভিন্ন ধরনের ফল, মিষ্টি, চিড়া কলার ফলার, নিরামিষ খিচুড়ি ইত্যাদি।
_____________________________
চতুর্মাত্রিক ব্লগে প্রকাশিত (অক্টোবর ২২, ২০১৩)
ছবি: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি উইকিপিডিয়া

Friday, January 12, 2018

কবি সমরজিৎ সিংহের জন্মদিন আজ


কবি সমরজিৎ সিংহের জন্মদিন আজ ৷ বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় সিদ্ধহস্ত এই কবির জন্ম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ৷ অজস্র কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন প্রচুর গদ্য — গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা সাহিত্য ৷ সম্পাদক হিসাবেও সমরজিৎ সিংহ খ্যাতনামা ৷ সত্তরের দশকে ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় গিয়ে প্রায় মুমূর্ষু 'কৃত্তিবাস' পত্রিকার প্রকাশনার সাথে যুক্ত হন তিনি ৷ এই সময়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাহচর্যে আসেন ৷ কৃত্তিবাস পত্রিকায় ছায়াতে বাংলা ভাষার অনেক বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক বেড়ে উঠেছেন ৷ এছাড়া ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের পত্রিকা 'ত্রিপুরা চে' , যেটি প্রকাশিত হত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায়, তার সম্পাদক হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন ৷ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার লেখক সম্প্রদায় সৃষ্টিতে 'ত্রিপুরা চে'র ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ৷ 'এবাকা' নামে আরেকটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন মাতৃভাষায় ৷ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কবিতার সমকালীনতায় সমরজিৎ সিংহ একজন পথিকৃৎ ৷ মাতৃভাষায় কবিতা লিখেছেন অনেক কম, কিন্তু মননশীলতার সমরজিৎ সিংহের ধারেকাছে কেউ নেই ৷
মুক্তপ্রাণ, প্রাণোচ্ছল আর তারুণ্যে ভরপুর মানুষটিকে জন্মদিনের অজস্র শুভেচ্ছা ৷
সমরজিৎ সিংহ
খন্ডগ্রাস
পরপারের আলো এসে পড়েছিল তার চিঠির অক্ষরে ।
ঐ আলো, যাকে ধ্বনিসম্ভব বলে জানি,বৌদ্ধগুহা হয়ে ঘুরপথে
এসে পড়েছে মৃত্যুর হাত ধরে ।চিঠির প্রতিটি অক্ষর
ক্রমে হয়ে উঠেছিলো ,হয়তো, রাঢ়সংস্কৃতমিশ্রিত ।
যে শব্দটি এর ভেতর ,একা,ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলতে তৎপর,
কাতর ও উন্মুখ ,তা আসলে এক ম্লেচ্ছপ্রতিম ধ্বংসবীজ ।
সমরজিৎ সিংহ
সেয়াগ
টেইপাঙহান বুলিয়া চেইঙ মি
ঔহানল গরেৎত নিকুলেসু
গরেৎত নিকুলেসু বুলিয়া
হারৌহারে আট্টিঙ্গাহান ঙালসে
রইদহান ফিরালহার সাদে পাতালা অয়া পরেসে
পাহিয়া পলেই, জুনাক জিনজুনি হাবি
বুলে বুলে চাউরি টেইপাঙএহান
এতাহাবি হারৌর বিতরে তোর মেইথঙহান
ইমাম মামসে
বৌবরনর সাদে, আদারহানর সাদে
গরেৎত নিকুলিয়া মি কিসাদে গরআগৎ হমাসুহান
হারনাপাসু, সে সেয়াগ, ঈশ্বর
এপেইয়ৌ, তোর দুঃখ য়ারি হারৌতে কুরাং?