আজ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কাব্যসাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের জন্মদিন । ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় জেলার পাকইরপাড়ে জন্ম নেওয়া এই কবি প্রথম জীবনে বাংলায় কাব্যচর্চা করলেও পরবর্তী সময়ে বিচরনক্ষেত্র কেবল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যের অলিগলি। কবিতার পাশাপাশি গল্প, নাটক, কথাসাহিত্য ও অনুবাদেও পেয়েছেন সাফল্য। ১৯৭২ সালে ৪০টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'লেহাও ফুলগরে' ( চাঁপাফুল, তোমাকে) । তারপর আর থেমে থাকেননি । বিশাল কাব্যহৃদয়, তীক্ষ্ণ ও অপরিমেয় কাব্যশক্তি নিয়ে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কাব্যসাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন। একসময় আধুনিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কাব্যসাহিত্যের পথিকৃৎ হিসাবে আবির্ভূত হন ধনঞ্জয় রাজকুমার ছদ্মনাম নিয়ে।
বিংশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে যাত্রা শুরু হওয়া বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যের কবিতা ধাঁচটি ছিল মুলত বৈষ্ণব পদাবলি ও ভাবলুতা নির্ভর। ফুল-পাখি-লতা-পাতা-হরি-কৃষ্ণ-রাধে-বৃন্দাবন ব্যতীত কবিতা কল্পনা করা যেত না । এইসময় একজন কবি এসে বললেন, 'শ্মশানর জ্বি'গ আহির পানিল কিসাদে নিবানি', শ্মশানের চিতা কিভাবে নেভাই চোখের জলে ? লোকজন অবাক, যাহ এভাবে কবিতা হয় নাকি । তারপর বললেন, 'ইশ্বরর লগে তুলনা দিয়া চেইতে মি কতি তলয়া আছু', ইশ্বরের সাথে তুলনা করতে যেয়ে দেখি আমি কতখানি ছোট হয়ে আছি। কি বলছে এই লোক, ইশ্বরও কি মানুষের মতো তুলনা দেয়ার রূপক হতে পারে ! কবিতা যে কেবল গান নয়, চিত্রকল্প হতে পারে, নিজের বা সমাজের বাস্তব নিষ্ঠুর সত্যের নগ্নরূপ হতে পারে তা করে দেখালেন ধনঞ্জয় । ধনঞ্জয় রাজকুমারকে এজন্যই বলা হয় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি । হতাশা, দুঃখ, ক্লান্তি ও যন্ত্রনার ভিতরেও কোন আনন্দের উপকরন জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে কিনা তার সন্ধান করে চললেন ধনঞ্জয় । কবিতায় সামষ্টিক ও ব্যক্তিক বেদনা মিলেমিশে অবাক করা এক রূপ নিয়ে নিল, যা খুলে দিল আধুনিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি কবিতার প্রকরণ। ১৯৭৭ সালে ষোলোটি কবিতা নিয়ে বের হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, 'ডিগল আতহানল মোরে' । তিনি লিখলেন -
'ট্রেনের হুইশেল, মোটরের হর্ণ, প্লেনের শব্দ, ঘড়ির এলার্ম, তিনশ এগারো টাইপ রাইটারের খটখটখটখটখট, হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়া কাপ, রেডিওর ষ্টেশন খুঁজার শব্দ, আত্মহত্যার আগের নিঃশব্দতা, রক্তের কণায় অসহ্য চিৎকার মুক্তি মুক্তি, উত্তরন উত্তরন, হাজার হাজার বছরের কবিদের কবিতা পড়া আমার বুকে লাবডাব - লাবডাব - লাবডাব - ঈশ্বরের সাথে তুলনা করে দেখি আমি এখনো নিম্নজ। লাবডাব - লাবডাব - লাবডাব। সিস্টার দয়া করে আমার মুখে থার্মোমিটার দিন, আমার বুকে একবার কান পেতে শুনুন, হাতের নাড়ি দেখুন, দেখুন কতখানি কষ্ট পেয়েছি আমি, কতখানি যন্ত্রনার মৃত্যুর হাতে ধরে আমি আত্মসমর্পন করেছি কবিতার কাছে - সব লিখে রাখুন। আমার নিঃসঙ্গতার কবিতায় কার কঠিন নিয়তির মতোন স্থির নিস্তব্ধ মুখ, নিরুত্তাপ হাত? জানিনা কি করে আমার যন্ত্রনা, নারী ও ইশ্বরের সাথে তাবৎ কথোপকথন কবিতায় বিধৃত হবে? হে ঘড়ির কাঁটা, তুমি তো টিকটিকটিকটিকটিক - একটু জিরোও - আমাকে একটু সময় দাও, আমি কবিতার সাথে একটু সময় ঘুমোবো... হে আমার নিঃসঙ্গতা! আমার আত্মা! আমার পবিত্রতা! আমার পূণ্য! আমার পাপ! আমার ঈশ্বর! আমার কবিতা। '
(আমার কবিতা / অনুবাদ: কুঙ্গ থাঙ )
সরল অথচ অর্থময় এক প্রান্তিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটে চলে ধনঞ্জয়ের কবিতায়-
'আমরা যেদিন জলের কাছে গিয়েছিলাম, জল ছিল ঘুমে। ঘুম ভাঙাতে মায়া হলো বলে স্নান করিনি। আমাদের ওষ্ঠলগ্ন অক্ষরদেরও স্নান দিইনি আমরা। দুঃখটাকে পারলাম না জলাঞ্জলি দিতে।
আমাদের হাতে কে তুলে দিয়েছে এই ত্রিতাপ। আমার শুদ্ধ নই। আমরা তাই কোনকিছু উৎসর্গ করতে অক্ষম এখনো। হে শালপ্রাংশু আকাশ, তোমার পায়ের তলে মরার ভাগ্য নিয়ে জন্মানো এই পোঁকাপিপড়ের জীবন নিয়ে আমরা কী করবো, বলে দাও।'
(বলে দাও / অনুবাদ: শুভাশিস সিনহা )
কবিতায় এক নির্মোহ দার্শনিকতায় তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন এবং আহ্বান করেন-
'পথকে মালা পরিয়ে দাও
ওই পথের গর্ভ থেকে আমাদের জন্ম হয়েছিল।'
(পথ / অনুবাদ: শুভাশিস সিনহা )
এভাবে নতুন চিন্তা, নতুন কাব্যবীক্ষা, বৈশ্বিক চেতনার সাথে জাতিগত ঐতিহ্য ও অনুষঙ্গের শৈল্পিক সংশ্লেষ নিয়ে তাঁর কাব্যসাধনা এগিয়ে চলে।
ধনঞ্জয়ের কবিতা দুঃখময় । কবি নিজেও স্বীকার করেন, কি করব যখন, কবিতা লিখি তখন দুঃখ এসে পাশে বসে থাকে । দুঃখকে কবি নতুন রূপে আবিষ্কার করে চলেন কবিতায়, হৃদয় তোলপাড় করে দেয় সে দুঃখ। যেমন -
'শূণ্যে একটি শব্দকে বললাম-
যাও, পদ্ম হয়ে ফোটো।
একজন নারীকে বললাম- যাও,
তার পাশে চন্দ্রকলার ভঙিমায় দাঁড়িয়ে থাকো।
মুখে তোমার ঝরে পড়ুক টলটল করা
একবিন্দু অশ্রুজল।
সে ঢেউয়ে স্মৃতির মত তিরতির কাঁপবে
পদ্ম।
বিষাদের মাঝে সে মুচকি হেসে বলে,
আমার নাম দুঃখ। আমাকে চেননা !
আশৈশব তোমার সখা হয়ে আছি যে। '
(দুঃখ / অনুবাদ: কুঙ্গ থাঙ)
কিংবা স্বপ্ন ও স্মৃতির সাথে বাস্তবতা ও বেদনার অবধারিত এই সংঘাত মনকে আচ্ছন্ন করে দেয় -
'কণ্ঠকে বললাম -চারদিক খুঁজে খুঁজে খবর নিয়ে এসো
কিছুক্ষন পর প্রতিধ্বনি ফিরে এলো
বলল, রোদ-বৃষ্টি-বরিষা-শরৎ-সকাল-বিকাল সবদিকে নিয়েছি
চাঁপাগাছে একটিমাত্র ফুল
শৈশবের সাথে স্মৃতির সাঁকো হয়ে আছে।
ওইদিকে পার হয়ে দুরে একটি দ্বীপ নিয়ে দেখলাম
কতদিন কতযুগ কত জন্মের স্বপ্নকে
এক আশ্চর্য গন্ধ পাহারায় রেখেছে
নিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞানটুকু হারিয়ে
পরিচয় দিতে পারলাম না
যদিও পেয়েছি, এক অন্যকে চেনা হলো না
কেউ কারো কথা পারলাম না বুঝতেই
প্রতিধ্বনি হাহাকার করে বলল -
কেন আমাকে ওই পথে পাঠিয়েছিলে!'
(খবর / অনুবাদ: শুভাশিস সিনহা )
ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পয়তাল্লিশ, এরমধ্যে কাব্যগ্রন্থ প্রায় তিরিশটি । কালিদাসের 'মেঘদুত'সহ নানান ভাষার কবিতার অনুবাদ করেছেন মাতৃভাষায়। ১২০টি জাপানি হাইকু কবিতার সংকলন 'মিকুপর চেরিফুল'। বিশ্বের প্রায় ৬০টি ভাষার কবিতার বিপুল কাব্যসম্ভার নিয়ে লেখা 'অনুবাদকল্প' তার অনবদ্য কীর্তি। ছন্দ নিয়ে বই লিখেছেন, লিখেছেন মাতৃভাষার উপর ব্যাকরন। লিখে যাচ্ছেন অবিরত। নিজেকে অতিক্রম করে চলেছেন ক্রমাগত । সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নতুন কবিতার বই, 'জলছিটা না পানিছিটা'। সেখান থেকে আরেকটি কবিতা তুলে ধরলাম -
রাতিহানর বুকগৎ গাছ আকজার রুয়া দেছিলু৷
ঔজার ডাঙর অয়া ডেঙপাল সালকরিয়া
রাতিহানরে গুরে বেলাছে বুলিয়া
মানুয়ে য়ারি দিতারা ।
মি বাসেয়া আছুতাই
ঔজারে কিতা ধরতইতা চেইঙ বুলিয়া
না ফল না দরিয়া
ইমে ছেয়াগ অয়া থায়তইতা ?
রাতের বুকে একটা গাছ লাগিয়েছিলাম৷
লোকজন বলছে
গাছ নাকি বড় হয়ে ডালপালা মেলে
রাতকেই ঢেকে ফেলেছে !
আমি আবার অপেক্ষা করে আছি
ঐ গাছে কি ধরে তা দেখার জন্য
আদৌ কি ফল ধরবে,
নাকি এমনই থাকবে, ছায়া হয়ে ?
বাংলা কাব্যসাহিত্যে ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহের সাফল্যও প্রশ্লাতীত । বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে তাঁকে অন্যতম প্রধান বিবেচনা করা হয়। বাংলায় দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।
( ১ ) ত্রাণ শিবির
( ২ ) ভিখারী বালকের গান। প্রবন্ধের বই --ছন্দের কারিগরি।
এর বাইরে তিনি একজন বড় মাপের রবীন্দ্র গবেষকও । সম্পাদনা করেছেন রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ--উত্তরা।
নিত্য অভিজ্ঞতার মোড়কে প্রাত্যহিকের নানা বৈপরীত্য মেলে তাঁর বাংলা কবিতায় । যেমন -
'শব্দ, অর্থ, উপমা উৎপ্রেক্ষা আর বাকপ্রতিমার সঙ্গে
মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়।
নার্সিংহোমের দরজায়, ডাক্তারের ভিড়ঠাসা
চেম্বারের মোমের আলোয়।
ম্লান হাসি বলে দেয় ওরা কেউ ভালো নেই।
কি খবর ! এই চলে যাচ্ছে আর কি ।
তবে সুগার অনেকটা হাই, ঘুম কম ।
ই সি জি রিপোর্ট খুব ভালো নয়।
গ্যাস পাও ঠিকমতো! জিনিসের দাম কিরকম
বেড়ে যাচ্ছে ।
ছেলেরা কি করছে , তোমাদের টি ভি তে বাংলাদেশ
কি রকম পাও ?
কালকের খবর শুনেছ?দিন দিন কি হচ্ছে এ সব ?
এ রকম আলাপের পর অনিবার্য — চলি, দেখা হবে।
দেখা হয়ে কি হবে এখন !'
(দেখা হয় / ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ )
শুভ জন্মদিন কবি ব্রজেন্দ্র ।
শুভ জন্মদিন কবি ধনঞ্জয় রাজকুমার ।